রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০১ পূর্বাহ্ন
জাতীয় ডেস্ক : রাশিদা আক্তার রুমার বাঁ পায়ের ক্ষত থেকে এখনও মাঝেমাঝে রক্ত পড়ে। তার এই ক্ষত ১৭ বছর আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসের সাক্ষী।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বিকালে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের। তার আগে রাস্তায় ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ করে চলছিল সমাবেশ। কথা ছিল, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরপরই শান্তি মিছিল শুরু হবে।
কিন্তু গ্রেনেড হামলায় স্বতঃস্ফূর্ত সেই সমাবেশ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেলের মধ্যে এখানে ওখানে পড়ে ছিল লাশ, খণ্ড-বিখণ্ড দেহাবশেষ, মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছিল আহতদের কাতর ধ্বনি।
সেই হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের তখনকার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমানসহ ২৪ জন, আহত হয় কয়েকশ মানুষ। সেদিন বেঁচে গেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হামলায় নিহতরা চলে গেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু সেদিন যারা কাছ থেকে সাক্ষী হয়েছিলেন, শরীর আর মনে এখনও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের।
চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেলেও অব্যাহত কষ্টের জীবনে প্রয়োজনের সময় দলীয় নেতাদের পাশে না পাওয়ায় ক্ষোভ জমেছে কারও কারও মনে।
তাদেরই একজন পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাশিদা আক্তার রুমা। ঘটনার সময় কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তিনি, এখন দলের কোনো পদে নেই।
তিনি বলেন, “পিঠে, উরুতে, পায়ে শত শত স্প্লিন্টার, এমনকি হাড়ের ভেতরেও। এই হাড়ের ভেতরের স্প্লিন্টারগুলো যখন নড়াচড়া করে, মনে হয় নিজের পা নিজে কেটে ফেলি।”
রুমা জানান, ওই হামলায় আহত হওয়ার পর চিকিৎসকরা তার পা কেটে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাবের হোসে চৌধুরীসহ দলের কয়েকজন নেতা না কাটার পরামর্শ দেন।
“আবার পরে যখন কাটতে চাইছিল, তখন আপা (শেখ হাসিনা) না করেছেন। আপা তখন বলছেন, ‘পা রাখ, যত টাকা লাগে আমি দেব’।… এখন শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপের দিকে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে রক্ত যায়, চেহারা ফুলে যায়। পা, পেট ফুলে যায়। ডাক্তাররা বলেছেন কিডনিতে সমস্যা হয়েছে।”
রুমা জানান, চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি তা আর হয়নি।
“আমরা কয়েকজন মিলে অনুরোধ জানিয়েছি, উন্নত চিকিৎসার জন্য যাতে দেশের বাইরে যেতে পারি। দুই চারটি অপারেশন আছে, এটি করা না হলে আমাদের শরীরে ইনফেকশন থেকে যাবে। আমাদের যে রডগুলো আছে তা বের করা হয়নি।
“স্প্লিন্টার বের করতে হলে জার্মানি যেতে হবে। বিশেষ প্রযুক্তি নাকি সেখানে আছে। তা না হলে এসব স্প্লিন্টার কীভাবে বের করবে? এত স্প্লিন্টার শরীরের মধ্যে, চামড়া কাটতে হবে, মাংস ফেলে দিতে হবে। বাংলাদেশ তো কোনো চিকিৎসা নেই।”
উন্নত চিকিৎসা না পেলে নিজের পা কাটার কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন ডান পা কিছুটা ভালো কিন্তু বাঁ পায়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি। ১৭ বছরে মধ্যে এই ঘা শুকায়নি। ডাক্তার বলছে, পা কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নাই।”
স্বামী মারা যাওয়ায় দুই মেয়েকে নিয়ে সংসারের ভার বইতে হয়েছে রাশিদা আক্তার রুমাকে। সরকারি সহায়তা পেলেও চিকিৎসার পুরো খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
রুমা জানান, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সহায়তা হিসেবে এককালীন ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে তাকে। ওই টাকা ব্যাংকে রয়েছে, সেখান থেকে মাসে আট হাজার টাকা করে লাভ পান, সেটা সংসারের পেছনে ব্যয় হয়। এর বাইরে চিকিৎসা খরচ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে তিনজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেও আশ্বাস ছাড়া আর কিছু মেলেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই আওয়ামী লীগ কর্মী।
তিনি বলেন, “এখন মনে হচ্ছে তখন মরে গেলেই ভালো হত, এত কষ্টের জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল। আমাদের নেত্রী, উনি একা কতদিন দেখবেন? আপা নিজেরও তো সেই ঘটনায় আহত হয়েছেন। তিনি আমাদের খেয়াল করেছেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এখনও ট্রিটমেন্টের জন্য টাকা দিচ্ছেন।
“কিন্তু আমার ওষুধ লাগছে ১০-১২ হাজার টাকার। যে এফডিআর করে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে আমরা আগে মাসে পেতাম ১০ হাজার ৬০০ টাকা। এখন পাই ৮ হাজার ৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না, ৫ হাজার টাকা দিয়ে ওষুধ চলে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে পারছি না যে এটা আপনার দায়িত্ব।”
রাশিদা আক্তার রুমা আক্ষেপ করে রুমা বলেন, “যে বয়সে বাচ্চারা পড়াশোনা করে সেই বয়সে আমি বাচ্চা দুটোর বিয়ে দিয়েছি। কারণ বাই চান্স আমার কিছু হয়ে গেলে… চাচা, ফুফু আছে, তারা কতদিন দেখবে।
“আমার নেত্রী আমার জন্য অনেক করেছেন, এরপর আমার নিজেরও প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।… আমরা যারা সেদিন আহত হয়েছি, আমাদের প্রত্যেকের এলাকায় এমপি আছেন, তারা কখনো কোনো সহায়তা করেননি, এমন কি খবরও নেননি।… তাহলে এই যে ত্যাগ স্বীকার করলাম, কাদের জন্য বলেন?”
শরীরে থেকে যাওয়া কয়েকশ স্প্লিন্টারের ব্যথা কমানোর চেষ্টা করতে গিয়ে কিডনি জাটিলতায় পড়ার কথা জানিয়েছেন নাজমুল হাসান নাজিম। হামলার দিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানের পাশেই ছিলেন।
নাজিম জানান, সে সময় তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা যুবলীগের সহ সম্পাদক। ঢাকায় এসে আইভী রহমানের সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের কথা শুনে আইভী রহমানের সঙ্গে তিনিও গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে।
“মঞ্চের একেবারে কাছে আমি ছিলাম। নেত্রী বক্তব্য শেষে যখন বললেন, এখন র্যালি হবে, তখনই বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ। আমি একেবারে ট্রাক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন, তখনই এই ঘটনা।
“আইভী আপা নিচে ছিলেন, আমি পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। বিকট শব্দের পর তিনি পড়ে গেলেন। তাকে সেইভ করার জন্য তার কাছে যেতে যেতে আমিও আহতে হলাম। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।”
নাজমুল হাসান নাজিম সেদিন গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হন নাজিম। পেট ফেটে ভুড়ি বেরিয়ে আসার অবস্থা হয়, পায়ের অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস নিয়ে সেই পা মেরামত করার চেষ্টা করেছেন চিকিৎসকরা। প্রাণে বেঁচে গেলেও পা আর ভালো হয়নি।
“শরীরে অনেক স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। ১০-১২টা অপারেশন শুধু আমার পেটেই হয়েছে, পরে পায়ে হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে আপা উন্নত চিকিৎসা দিয়ে এনেছেন। স্প্লিন্টারগুলো সব আর বের করা যায়নি।”
নাজিম জানান, স্প্লিন্টার থেকে যাওয়ায় শরীর অনেক সময় ‘অবশের মত’ হয়ে যায়। যেখানে স্প্লিন্টার আছে, গরমের সময় সেখানে খুব চুলকায়। ওষুধ না হলে, দিনে কয়েকবার গরম পানি না ঢাললে আর চলা যায় না।
“ব্যথার কারণে ট্যাবলেট খেতে খেতে এখন কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার বলেছে এই ট্যাবলেট আর খাওয়া যাবে না। আমিনএখণ কিডনি নিয়ে বড় সমস্যায় আছি। অধৈর্য হয়ে গেছি, কী দিয়ে কী করব।”
নাজিম বলেন, “মা বাবা যেভাবে দেখেন, আপা (শেখ হাসিনা) সেভাবে আমাদের দেখেছেন। আপার মত আর কেউ দেখে না। তিনি একা কত দেখবেন। অন্যরা উনার মত তো না। জিল্লুর রহমান সাহেব করেছিলেন। আপা আসলে অনেক চেষ্টা করেছেন আমাদের জন্য। উনি ওই সময়ে উন্নত চিকিৎসা না করালে আজকে আমি হয়ত এই অবস্থায় থাকতাম না। সবাই ভেবেছিল আমি মারা গেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে আছি।”
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply